Breaking Bharat: পুরী বেড়াতে গেছেন নিশ্চয়ই,কোনারকের সূর্য মন্দির (Konark Sun Temple) দেখেননি তা কি হয়? জানেন কি এই মন্দিরের ইতিহাস কিন্তু বেশ অন্যরকম? সুবিশাল ভারতবর্ষ! স্থাপত্য ভাস্কর্যের আছে কত বিস্ময়। যুগের পর যুগ চলে গেলেও কিছুই জানা হয়নি। তাই এখনও একাধিক প্রশ্ন ভিড় করে আসে মনের গভীরে। কোন স্থানে ঘুরতে গেলে সেই স্থানের ব্যাপারে পড়াশোনা করেই আজকাল যাওয়া হয় (Konark temple mystery)।
কিন্তু সেখানে পৌঁছে যেন আরও অনেক অজানা তথ্যের ভাণ্ডার উন্মোচিত হয়। তেমনই এক স্থান হল কোনারক। পুরীর সমুদ্রের ঢেউয়ে নিজেকে ভেজাতে চান যারা, সূর্য মন্দির ভিজিট করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেন তারা। এই মন্দিরের ইতিহাস কী বলুন তো? কেন এত বছর পরেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে এই সূর্য মন্দির? (Who built Sun Temple at Konark?)
“কোনারক” নামটি সংস্কৃত শব্দ কোনা মানে কোণ এবং আর্ক অর্থাৎ সূর্য, এই শব্দগুলির সমন্বয়ে গঠিত, যা মন্দিরের উল্লেখিত সৌর দেবতা সূর্যকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। অর্থাৎ সুর্য্যের বিভিন্ন কোণের অবস্থান।বিশ্বাস করা হয় যে মন্দিরটি ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের নরসিংহদেব নির্মাণ করেছিলেন।
মন্দিরের গড়ন একটি বিশাল রথের আকৃতির যা বিস্তারিতভাবে বলা যায় পাথরের চাকা, স্তম্ভ এবং দেওয়ালগুলি তৈরি করা হয়েছে এখানে। যদিও কালের গতির নিয়মে কাঠামোর একটি প্রধান অংশ এখন ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মন্দির ত্রয়োদশ শতকে উড়িষ্যা রাজ্যে নির্মাণ করা হয়।মন্দিরটি বিশ্বের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং ভারতের সাতটি বিস্ময়ের তালিকাতেও রয়েছে। (Konark Sun Temple history)
ভৌগলিক অবস্থান বলতে গেলে, মন্দিরটি পু্রী থেকে মাত্র ৩৫ কিমি এবং ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত । ইউরোপীয় নাবিকরা একে ব্ল্যাক প্যাগোডা বলতেন। এই মন্দিরটি সুর্য্যের বিভিন্ন অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে বলে মনে করা হয়। মন্দির গড়ে ওঠার পেছনে দুটি মত আছে (konark sun temple facts)।
প্রথমত: পূর্বগঙ্গা রাজবংশের নরসিংহদেব ১২৩৮-১২৬৪ বা ১২৩২-১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে বাংলা জয়ের স্মারক রূপে চন্দ্রাভাগা নদীর তীরে প্রাচীন মৈত্রিয়ারনে অর্থাৎ সাজেকের কোনারকে এই মন্দির প্রতিষ্টা করেন।(the Sun temple of Konark famous)
দ্বিতীয়ত: পুরান মতে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র সাম্ব, রূপে-গুণে ছিলেন আকর্ষণীয়। নারীদের নজর কাড়তেন তিনি সহজেই। সাম্ব একদিন নারদের ডাকে সাড়া দিতে ভুলে যান। দেবর্ষি এতে ক্ষুব্ধ হন। এরপর তিনি সাম্বকে শাস্তি দেওয়ার ফন্দি আঁটেন।এক দিন কৃষ্ণ যখন গোপিনীদের সঙ্গে লীলায় ব্যস্ত তখন নারদের ছলনায় সাম্ব সেখানে প্রবেশ করলে গোপিনীদের নজর তার দিকে পড়ে।
এতে ক্রুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণ অভিশাপ দেন যে সাম্ব তার রূপ হারাবে। পিতৃ অভিশাপ পাওয়ার পর মনের দুঃখে সাম্ব কোনারকে সমুদ্রের তীরে সূর্যদেবের কঠোর তপস্যা শুরু করেন। তাকে প্রসন্ন করে আশীর্বাদ স্বরূপ নিজের হারানো রূপ ফিরে পেয়ে সমুদ্রতীরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরে সূর্যদেবতার যে বিশাল বিগ্রহ ছিল তা এখন নেই। কালের করাল গ্রাসে স্থাপনার অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর কয়েকটি কারণ আছে।
প্রথমত, বাংলার সুলতান সুলেমান খান কারানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণে কোনারক মন্দির সর্ব প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে জানা যায়। উড়িষ্যার ইতিহাস অনুযায়ী কালাপাহাড় ১৫০৮ সালে আক্রমণ করেন।
দ্বিতীয়ত, নরসিংহদেব মুসলিম মেয়ে কে বিয়ে করার জন্যে রাজ্য থেকে বহিস্কৃত হন । তাই তিনি নিজে মন্দির ধ্বংস করেন।
তৃতীয়ত, ১৬২৬ সালে খুরদার তৎকালীন রাজা পুরুষোত্তম দেবের পুত্র নরশিমা দেব সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য এবং চন্দ্র দেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। শুধু বিগ্রহই নয় তিনি কোনারক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। এমনকি নবগ্রহ পথ নামে একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও তিনি পুরীতে নিয়ে যান।
মারাঠা শাসনামলে কোনারক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭৭৯ সালে কোনারক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। সেই সময় মারাঠা প্রশাসন নাটমন্দির অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে। সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর কোনারকে পূজা এবং আরতি বন্ধ হয়ে যায়।
আরো পড়ুন- The sea is blue : কেন সমুদ্র নীল? নীল রং কি প্রকৃতির ভীষন প্রিয়?
চতুর্থত, পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোনারক বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়।এর ফলে তারা মন্দিরের মাথায় অবস্হিত অতি শক্তিশালি চুম্বক নষ্ট করে দেয়। আঠারশ শতক নাগাদ কোনারক মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায় ।মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায় ।বুনো জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতর। জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় এই মন্দির। মনে করা হয় সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেতেন না।
আরো পড়ুন- Fish smell weird: পুকুর বা সমুদ্রের জলের মাছের গায়ে বেশি আঁশটে গন্ধ হয় কেন ?
বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ববিদরা কোনারক মন্দির পুনরায় আবিষ্কার করেন। প্রায় ৩০০ বছর ধরে বালির স্তূপের নীচে পড়ে থাকা এই সূর্য মন্দিরটি কে ১৯০৪ সালে বড়লাট লর্ডকার্জন উদ্ধার করেন৷ তবে তারও আগে বিপর্যয় জনিত কারণে মূল সূর্য মন্দিরটি অবুলুপ্ত হয়। যেটাকে মন্দির হিসেবে এখন দেখা যায় সেটা আসলে নাট মন্দির, মূল মন্দির নয়৷
আরো পড়ুন- Blood donation rules: রক্ত দান জীবন দান, মহৎ কাজ করার পর কী করবেন, জানেন?
সূর্য মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী,বিষ্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার যার কিছুটা এখন সূর্য মন্দির জাদুঘর ও উড়িষ্যার জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী সূর্য মন্দির দেখতে ভিড় জমান ।প্রাচীন ভারতীয় স্থপতি ও ভাস্করদের শিল্পনৈপুণ্য ও সৃষ্টিশীলতা আজও মানুষকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে।