Breaking Bharat : কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক (Bidyut Bhowmick) : আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি— মহৎকবির লক্ষণই হল নিজের কবিতায় আত্মস্থভাবের আবিষ্কার করা, এবং তাতেই পূর্ণ অভিনিবিষ্ট হওয়া । এই প্রেরণা-ই আমাকে দিয়ে শুধুকবিতা লিখিয়ে নিয়ে চলেছে ! তাই কোনো লোভের দিকে এই চোখচুপ সরলতায় তাকাবার প্রয়োজন বা ইচ্ছা কখনোই কবি বিদ্যুৎ ভৌমিকের হয়-নি এবং হবে-না , এটা জোর গলায় বলতে পারি ।
আরও পরিষ্কার করে যদি বলি , কোনো কাগজের চাহিদা মেটাতে বা যুগের আবহাওয়ায় নিজেকে বহতাময় স্রোতে ভেসে যেতে দিতে পারি না । অর্থ সাধনায় ব্রতী হই-নি ও হব-না । আমি আমাকে একেবারে নিঃসঙ্গ রেখে ধীরে ধীরে এগিয়েছি , কোনো চোটুল প্রলোভনে কখনো আমার ধ্রুব বিশ্বাস থেকে এক বিন্দু-ও সরে আসি-নি , খ্যাতির জন্য কোনো কৌশলী প্রচেষ্টা কোনোমতে চালাই-নি । তাই তো কবিতাপ্রাণ পাঠকসমাজের মুখে মুখে সেই—যে আমার সেই বিখ্যাত কবিতার অমোঘ পংক্তি শুনতে পাই, যে পৃথিবী ভেজার কথা / সে পৃথিবী ভেজেনি “— ! এই ধ্বংসের মারমুখী সময়ে কবিতার কতটা প্রয়োজন আছে ? এটা আমিও অনেকবার আমাকে প্রশ্ন করেছি ।
ডারউইনের বিবর্তনবাদে বাঁদর থেকে মানুষে রূপান্তর হলেও এই মানুষের মনোবৃত্তি , হিংসা-দ্বেষ-পরশ্রীকাতরতা যে সহজে যাওয়া-র নয় ! পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখনো সনাতন ধর্মের অভিশাপ , জাত-প্রথার আচরণ~বিধি স্তম্ভিত করে রাখে । অথচ আমরাই উপগ্রহ নিক্ষেপণ করি বহিরাকাশে ! এটা আমাদের লজ্জার ! এই জন্যেই কী এতো কবি- শিল্পী এবং সাহিত্যিকের জন্ম , কী করতে পারেছি আমারা ?
এই পৃথিবীটাকে ভালোভাবে রাখতে পেরেছি , না আমারা ভালোআছি , বলুন ? এসব চিন্তা করেই আমার কাব্যগ্রন্থ— কথা না রাখার কথা “— লিখেছিলাম ! আমি কবিতা-কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি চলি,কথা বলি ! এ কথা আমি এর আগে আমার কবিতানির্ভর বহু সাক্ষাৎকার-এ বলেছি ।
কবিতাচর্চাতো সাহিত্য ও ভাষা চর্চার নামান্তর । আমাদের সৃষ্টির ও সংস্কৃতি মেধা মননের এবং কল্পনা ও উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ ঘটে সেখানে । কিন্তু অন্যদিকে এটা আবার দুঃখেরও সংবাদ !দুঃখ এই কারণেই যে , যেভাবে লেখক সংখ্যা বাড়ছে — সেভাবে কি পাঠকও তৈরি হচ্ছে ? আমি মনে করি , কবিতার নির্দিষ্ট কিছু সংজ্ঞা নেই , ব্যক্তিগত ধারণাতেই কবিতা সঞ্জীবিত । কবিতা মানুষের জীবন ধারণের সামগ্রী না হলেও বেঁচে থাকার কিছুটা অবলম্বন-তো বটেই । এটা একটা বহমান প্রবাহ ।
বাংলা কবিতা নিয়ে যে পরীক্ষা নিরীক্ষণ চলছেই তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই বলেই চলে । তবু বেনোজলে আমাদের বোধ ভেসে যাচ্ছে , অনেক লেখা পাতে এসে পড়েছে , কিন্তু অখাদ্যের কারণে মননে পৌঁছাচ্ছে-না ! যে হারে কবিতা ও কবির সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে , তাতে ভালো বা প্রকৃত কবিতা লেখা বাড়ছে-না ! সাহিত্যে আনন্দের ভোজে প্রকৃত মগ্ন পাঠককে অধিকাংশ সময়েই উপোস দিতে হচ্ছে !আমি বিশ্বাস করি আমার সময়ের সঙ্গে কবি বিষ্ণু দে ও বুদ্ধদেব বসুর কালের এই যে গুণগত পার্থক্য,এর জন্যই সম্ভাবত কবিতা পত্রিকার সমান্তরাল ইদানিং আর কোনো পত্রিকা নেই বাংলা ভাষার ।
অবশ্য এর মধ্যে অনেক বৃদ্ধি ওপ্রসার পেয়েছে কবি যশো প্রার্থীর সংখ্যা ! কিন্তু – কবিতা – তো
কেবল কবিতা ছাপানোর কাগজ বা পত্রিকা ছিল না । – কবিতা -ছিল সত্যিকারের কবিতার জন্য নিবেদিত পত্রিকা । রবীন্দ্রনাথের মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পী অথবা মানুষ ছিলেন না কবি বুদ্ধদেব
বসু । কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন বটে ! কর্মযোগী নন আপাত অর্থে । শিল্পকর্মকেই তিনি একমাত্র শ্রেষ্ঠ করণীয় কাজ ভাবতেন । যখন অনুবাদ করেছেন সমস্ত অন্তরাত্মা ঢেলে দিয়েছেন সেখানেই । সম্ভবত এই একটা জায়গায় কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসু ছাড়িয়েও গেছেন রবীন্দ্রনাথ-কে ! আবার কবি জীবনানন্দ-কে তো অবশ্যই । জীবনানন্দের অনুদিত কোন কবিতাই আমার চোখে পড়েনি আজ পর্যন্ত । অথচ বোদলেয়র কিম্বা রিলকে !
যাই হোক , কবিতা-চর্চা নিয়ে অনেক অনেক কথা ও লেখা হয় বা হচ্ছে , কিন্তু আমার বিচারে গত ১০ বছরের মধ্যে একটাও প্রকৃত কবিতা আমি দেখতে পাই-নি ! এটা আমার একেবারেই ব্যক্তিগত মতামত বলতে পারেন । প্রথম শ্রেণীর বেশিরভাগ ভালো পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হলেই-যে ভালো কবিতার জন্ম হয়েছে,এটা আমার কাছে সত্যি হাস্যকর ! একটা কথা এখানে বলা যায় আমার অনেক কবিতা-কে আমি নিজেও ক-বি-তা বলে মনে করি না !
আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি ,প্রত্যেক কবিদের একটা উদার ডিসিপ্লিন থাকা ভীষণ জরুরি ! ডিসিপ্লিন-এর অভাবেই বোধকরি কবিদের কলম দিয়ে ভালো লেখা প্রকাশ পাচ্ছে না !এটা ভীষণ দুঃখের কথা , তাই না ? যাঁরা সৃষ্টি করেন, তাঁরা এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের ও আল্লার সমতুল্য বলা যায় । তারাই যখন কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে ঘৃণ্য কাজ করে বসেন , তখন সেই
কবিদের প্রতি সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা চলে যায় ! এইজন্য সকলকেই সাচ্চা ও পবিত্র থাকতে হবে , তা-না হলে কবিতার জন্ম বৃথা হবে ।
এই সময়ের সবচেয়ে স্বনিয়ন্ত্রিত লেখক ও কবি হয়ে উঠতে আমি অহর্নিশ আদ্যোপান্ত চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছি । আমার চোখে কতযে ধান্দাবাজ লোকজন ঘুরছে-ফিরছে , আমার এই-যে ইদানিংকালেএতো নাম-ডাক সেটাকে মাটিতে মিশিয়ে দেবার জন্য ওরা সর্বত্র প্রস্তুত হয়ে আছে এ ব্যাপারে আমি সব-সময় সতর্ক থাকি, যাতে এতো-দিনের সাধনা বিফলে না যায় ! আবার ভালো মানুষজন-ও আছেন , তাঁরা আমাকে সবসময়ই প্রেরণা দিয়ে চলেছেন !
তাই দু’ই দিকটাই আমাকে রক্ষা করতে হয় ! সুনাম রক্ষা করাটাও একটা বিশেষ যোগ্যতা , তাইনা ? আসলে নিজেকে সবসময়ই পবিত্র করে রাখতে হয় ! আসল কথাটা হ’চ্ছে , আমি কোনো কিছুর জটিল বন্ধনে বাঁধা পড়তে রাজি নই এতে নিজের সৃষ্টির কাজে ক্ষতি হয় । নানা তালে ঘুরতে আমি কিন্তু রাজি নই । এটা বলতেই হয়,আমার লক্ষ্য একটাই আমি যা কিছু লিখি , সেগুলো পাঠকদের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছে দেওয়া । তাই এক জায়গায়—আটকা পড়ে থাকা আমার স্বভাবে নেই । থাকলে হয়তো এই-যে বিদ্যুৎ ভৌমিক আপনাদের কবি হয়ে উঠতো না ।
আমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলি । কবিতার সাথে সারারাত জাগি । কখনো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আত্মতত্ত্বে নিজের মধ্যে মনের মানুষকে এইভাবে খোঁজার পথ ও আশ্রয় । মাঝেমধ্যে অনেক কথা মনে পড়ে,কত প্রিয় কবির মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে ! শক্তি দা,সুনীলদা,যাঁরা আমার কবিতাকে নিয়ে অনেক কথা সময়-অসময়ে বলেছেন , আমাকে অকৃপণ ভালোবাসা দিয়েছেন , তাঁদের কথা বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয় !
অনেক সময় আমার এই কবিতার দর্শন পজিটিভ হলেও পাঠকের দর্শনে গলদ অনেকটাই অনেক সময় থেকে যায় । ফলে কবি ও পাঠকের মধ্যে মননের বিনিময়ের অদেখা শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে । অনেক সময় পাঠকরা আমাকে সামনে পেয়ে সরাসরি অকপটে আমার কবিতা সম্পর্কে বলেন,যা তাঁদের কাছে কোনোভাবে পরিষ্কার নয় । আমি মনে করি,কবিতার সমগ্রতার এই মহাবিষয়ের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে গেলে কবিতার বিষয়ে অন্তর্গত হতে হয় এবং কবিতা প্রাণ হতে হয় ।
আরও পরিষ্কার করে বলছি , কবির কবিতা নিয়ে এবং রচনার প্রস্তুতিপর্বের সময়কাল আবেগ প্রেম ব্যথা এবং যন্ত্রণা তার সাথে ইন্টারফিলোজফি অর্থাৎ অন্তর দর্শনটুকু ধরতে পারা বিশেষভাবে দরকার । এই বিশেষ জ্ঞানটুকু যাঁদের আছে তাঁরাই কবিতার একমাত্র প্রকৃত পাঠক , এটা আমি মনে ও প্রাণে বিশ্বাস করি । কবিতা অনুধাবন করতে গেলে কবিতার সাথে —আদ্যোপান্ত অন্তরঙ্গ হতে হবে ।
এমন অনেক পাঠক-কে আমি চিনি , যাঁরা কোনোদিন এক কলম-ও লেখেন-নি , তাঁদের কবিতা সম্পর্ক এতটা জ্ঞান-ধ্যান এবং ধারণা — আমাকে ভীষণ অবাক করে । এতটাই তাঁদের অনুধাবন করার অমোঘ শক্তি যা দেখে ওদের এই তুলনাহীন যোগ্যতার প্রতি আমার কবিতা-কে সঁপে দেই এবং নির্ভর করি ,এদের কথা শুনে গর্ব-ও হয় ।
এরা অত্যন্ত মেধাবী এবং অতিযোগ্য বলা যেতে পারে কবিতা বোঝার ব্যাপারে ও কবিতা-কে নিয়ে সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম বলে মনে করি তাঁদেরকে ।তাই আমার কবিতাপ্রীতি তাঁদের ভারসাম্যহীন কঠিন ও কঠোর সমালোচনাও আমাকে সব সময়ে ইন্সপায়ার্ড করে আসছে । এই অবকাশে তাঁদের প্রতি আমার পাহাড় প্রতিম কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি । যাই হোক , আমার এই রচনা অর্থাৎ কবিতানির্ভর এই বিশেষ নিবন্ধের মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম ।
সবাই ভালো থাকুন এবং সুন্দর থাকুন `জয় কবিতার জয়‘
বিদ্যুৎ ভৌমিক,৬৫ /১৭, ফিরিঙ্গি ডাঙা রোড,মল্লিকপাড়া,শ্রীরামপুর,হুগলি, সূচক ৭১২২০৩ পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ,মোবাইল ৬২৯০২৪৬৯৩২