Breaking Bharat: সতীপীঠ নয়, তবুও দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির কেন এত আকর্ষণ (dakshineswar kali temple)? দক্ষিণেশ্বর ছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণকে এভাবে পেত কি ধরাভূমি?
“জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বহা স্বধা নমস্তুতে”
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির (dakshineswar kali temple):
সৃষ্টির আদি ধারক বাহক মা কালী। পৃথিবীর নানা প্রান্তে সতীর দেহয়ের একান্নটি অংশ পড়ায় তা থেকে সতীপীঠ গড়ে উঠেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণেশ্বরে জগদম্বার মন্দিরটি কোন সতীপীঠ নয় বরং কল্পিত মন্দির।
মা ভবতারিণী নানা জানা অজানা কাহিনী ছড়িয়ে আছে দক্ষিণেশ্বরের আনাচে কানাচে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আধ্যাত্মবাদের বিকাশে স্বয়ং মা ভবতারিণী। ধর্মপ্রাণ মানুষের এই প্রিয় তীর্থক্ষেত্রের কিছু না জানা কথা আজ আপনাদের কাছে ইতিহাসের আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা (dakshineswar kali temple history) ।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস (dakshineswar temple)
ভাষ্কর্য্য স্থাপত্য মহিমা ইতিহাস সৌন্দর্য্য ইত্যাদি প্রতি ক্ষেত্রেই এই মন্দির বিশ্বের মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে। হুগলী নদীর তীরে কলকাতার খুব কাছেই উত্তর ২৪ পরগণার কামারহাটি অঞ্চলে দক্ষিণেশ্বর অবস্থিত।
কথিত আছে, ১৮৪৭ সালে রানী রাসমণি অন্নপূর্ণা পূজোর জন্যে কাশীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন কালে দেবী মা কালীর স্বপ্নাদেশ পান। এরপর ১৮৪৭ সালে গঙ্গার তীরে সমস্ত জমি বিক্রি করে রাণীমা মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৫৫ সালে হুগলি নদীর তীরে এই দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় আট বছরে ৯ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের মন্দিরে অবস্থিত বিগ্রহটি মাতা ভবতারিণী কালীকা নামে পরিচিত।
দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী মা (dakshineswar kali):
বঙ্গীয় স্থাপত্য-শৈলীর নবরত্ন স্থাপত্য ধারা অনুযায়ী তিন তলা দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়, যার উপরের দুটি তলে নয়টি চূড়া দেখতে পাওয়া যায়। উত্তোলিত দালানের ওপর মন্দিরের গর্ভগৃহটি স্থাপিত হয়েছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও গঠনগত দিক মূল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরটি নবরত্ন মন্দিরের আদলে গঠিত। এই আদলটি একেবারে বঙ্গীয় স্থাপত্যের একটি আদর্শ নিদর্শন।
মন্দিরটি তিনতলা এবং এর মুখ দক্ষিণ দিকে, যেদিকে গঙ্গার ঘাট। উপরের দুই তলায় মন্দিরের চুড়াগুলি বসানো রয়েছে। মধ্যিখানে একটি সর্ব বৃহৎ চুড়া এবং তাকে ঘিরে আরো আটটি চুড়া। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মোট নয়টি চুড়া বিদ্যমান। একটি উত্তোলিত দালানের উপর মূল গর্ভগৃহটি নির্মিত। দালানটি ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত এবং ১০০ ফুট উঁচু। মূল মন্দিরের পাশেই বারোটি আটচালা রয়েছে, এই আটচালা গুলি পূর্বমুখী।
প্রতিটি মন্দিরেই একই রকম দেখতে শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে রুপোর সহস্রদল পদ্মের উপরে মা ভবতারিণী শিবের বক্ষের উপর অবস্থান করছে। এছাড়াও রানী রাসমনির গৃহদেবতা দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রয়েছেন। মূল মন্দিরের আটচালা পূর্বমুখী দ্বাদশ শিব মন্দির রয়েছে। দক্ষিণে রয়েছে নাটমন্দির।
দক্ষিণেশ্বর ছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণকে এভাবে পেত কি ধরাভূমি?
উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে রুপোর সিংহাসনের সাড়ে ২১ ইঞ্চির কৃষ্ণ ও ১৬ ইঞ্চির রাধার বিগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে রাধাকান্ত মন্দির। উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাসগৃহ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ভাবে যাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংস। ১৮৫৫ সালে দাদা রামকুমারের সহযোগীরূপে এখানে আসেন। পরে রামকুমারের মৃত্যুর সময় তিনি দাদার স্থলাভিষিক্ত হন।
১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে ছিলেন। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। বহু দূর থেকে মানুষ ছুটে আসতে থাকেন মন্দিরে। মা ভবতারিণী এর মহিমা প্রচারিত হয় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মাধ্যমে। দক্ষিণেশ্বরে গেলে সত্যিই জগদম্বার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করে। এত জীবন্ত লাগে যেন মনে হয় ঈশ্বর আপনার সঙ্গেই রয়েছেন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে (dakshineswar kali temple)।
মা ভবতারিণী এবং শ্রীরামকৃষ্ণ (dakshineswar):
এই মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি স্বয়ং হেঁটে চলে সাধারণ মেয়ের মত উপলব্ধি করেছিলেন দেবীর অস্তিত্বকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কালী পুজোতে অত্যন্ত আবশ্যক বলে যে আচার মানা হয় দক্ষিণেশ্বর অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী। মা ভবতারিণী এবং শ্রীরামকৃষ্ণ (Sri Ramakrishna and Bhavatarini Kali) এই দুই নাম যেন রানী রাসমনির প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের অন্যতম ভিত ।
আপনি কি দক্ষিণেশ্বরী গিয়ে নির্বিঘ্নে পুজো দিতে চান?
কলকাতা থেকে মেট্রো করে কিংবা জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেনে করে বালি তারপর সেখান থেকে দক্ষিণেশ্বর যাওয়া খুবই সহজ। এখানে পূজা দিতে গেলে কোন পান্ডা বা ব্যক্তিগতভাবে পুরোহিত নিয়ে যেতে হবে না আপনাকে (dakshineswar tour)। এমনকি বাড়ি থেকে মিষ্টি নিয়ে গিয়েও পুজো দিতে পারেন আপনি। গঙ্গার ধারে ছিমছাম পরিবেশে মন ভালো হতে বাধ্য।
শিয়ালদহ থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির যেতে হলে ডানকুনি গামী ট্রেনে উঠে পড়ুন, মিনিট কুড়ি সময় লাগবে দক্ষিণেশ্বর স্টেশানে পৌঁছাতে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির। হাওড়া থেকে ট্রেনে করে বালি নেমে সিঁড়ি বেয়ে উপরের রাস্তায় উঠে আসুন, সেখান থেকে অটোতে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির (dakshineswar distance)।
এছাড়া বেলুড় থেকে গঙ্গা পার হয়েও দক্ষিণেশ্বর যাওয়া যায়। সম্প্রতি লাইট অ্যান্ড সাউন্ড এর উদ্বোধন করে দক্ষিণেশ্বরকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
ভারতবর্ষে যে ক’টি কালী সাধনা স্থল আছে, ‘দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির ‘তাদের মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ। ১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু এই নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে সহস্র পাপড়ির রৌপ্য-পদ্মের উপর শায়িত শিবের বুকে দেবী কালী দাঁড়িয়ে। একটি পাথর থেকেই তৈরি হয়েছে এই দেবীমূর্তি। তবে মন্দির উদ্বোধন নিয়ে বেশ কিছু জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
শোনা যায়, দক্ষিণেশ্বর মন্দির-উদ্বোধনের নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে রামকৃষ্ণের দাদা রানির প্রতিনিধিদের বলেন, রানি কৈবর্ত জাতি। তাঁর নিমন্ত্রণ ও দান গ্রহণ করলে তাঁকে ‘একঘরে’ হতে হবে। রানির বিশ্বস্ত ও সুদক্ষ কর্মীরা তাঁকে বোঝান রানি কিন্তু কৈবর্ত নন, মাহিষ্য সম্প্রদায়ের। শেষ পর্যন্ত রামকুমার রাজি হন এবং তাঁর ভাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা দিবসের এক দিন আগে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন।
সারা দেশ থেকে ১ লক্ষেরও বেশী ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত ছিল। দাদা দক্ষিণেশ্বরের প্রসাদ গ্রহণ করলেও গদাধর বাজার থেকে এক পয়সার মুড়ি-মুড়কি কিনে খেয়ে, ঝামাপুকুরে ফিরে আসেন। পরে দাদার নির্দেশে পঞ্চবটীতলে নিজের হাতে রান্না করে খেতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দুপুরে পঞ্চবটীতে পাক করলেও রাত্রে প্রসাদী লুচি খেতেন এবং জগদম্বাকে বলতেন, “মা, আমাকে কৈবতের্র অন্ন খাওয়ালি।”
আরো পড়ুন- Mithun Chakraborty : ডান্সের মহাগুরু মিঠুন চক্রবর্তীর সফলতার গল্প জানেন?
সেইসময় গরিব কাঙালরাও দক্ষিণেশ্বরে খেতে আগ্রহী ছিল না এবং খাওয়ার লোক না জোটায় প্রসাদী অন্ন গরুকে দেওয়া হত বা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হত। চাকরিতে ঠাকুরের আগ্রহ কখনওই ছিল না। কিন্তু রানির জামাই মথুরবাবু একপ্রকার জোর করেই তাঁকে বিষ্ণুঘরের পূজার দায়িত্ব দিলেন। এবং ভাগ্নে হৃদয়কে দুই ভাইয়ের সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন।
আরো পড়ুন- Ayodhya hills : ছৌ নাচের দেশ কি রামের অযোধ্যা পাহাড়? পুরুলিয়ার প্রিয় কি পাহাড় কি?
কিছুকাল বাদে ঠাকুরের পুজো দেখে মথুরবাবু শাশুড়ি রাসমণীকে বললেন, “অদ্ভুত পূজক পাওয়া গিয়েছে, দেবী বোধহয় শীঘ্রই জাগ্রতা হয়ে উঠবেন।” কথামৃত রচয়িতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর ফুটনোটে বলেছেন — ১৮৫৮ সালে রানি রাসমণির বরাদ্দের তালিকা অনুযায়ী ঠাকুর ওরফে রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় মাইনে পাচ্ছেন মাসিক পাঁচ টাকা। (পরে তা হয় সাত টাকা।)
আরো পড়ুন- Howrah Bridge: আজও কলকাতার সেরা আকর্ষণ রবীন্দ্র সেতু! পোশাকি নাম ‘ হাওড়া ব্রিজ’
তাঁর ভাগ্নে ‘পরিচারক’ হৃদয় মুখার্জির বেতন সাড়ে তিন টাকা। এঁর বাড়তি দায়িত্ব ছিল ফুল তোলার। এ ছাড়া বরাদ্দ তিন জোড়া কাপড়, যার মূল্য সাড়ে চার টাকা। সেই সঙ্গে প্রতিদিনের খোরাকি হিসেবে সিদ্ধ চাল, ডাল, তামাক, কাঠ। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির সত্যিই অপূর্ব দর্শনীয় তীর্থক্ষেত্র। তাই পূণ্য ক্ষেত্রে ঘুরে আসুন একবার।