Breaking Bharat: ইতিহাস মানে তার মধ্যে অজানা অনেক কিছু , যা নিয়ে রহস্য থেকে যায়। ইতিহাস মানে রাজ রাজাদের যুদ্ধ, ইতিহাস মানে অনেক না জানা কাহিনী । ইতিহাস মানে গুপ্তধন! মণিমাণিক্য, রত্ন, হিরে, জহরত। ইতিহাস বললেই এই সবকিছুই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে। কিন্তু হঠাৎ এইসব নিয়ে কথা কেন? ঠিক এই প্রশ্নটাই মনে মনে ভাবছেন তো? চিন্তা নেই উত্তর দেব আপনাকে। আজকের বিষয় কোহিনূর! সবথেকে আকর্ষনীয় আর সবচেয়ে বেশি মূল্যবান হয়তো বা অমূল্য!
ইতিহাস সমৃদ্ধ রত্ন বা বলা উচিত হীরা, তার নাম কোহিনূর
এটির গঠন সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে কি? এটি আসলে ডিম্বাকৃতির সাদা হীরে। এখনকার ওজন ১০৫ ক্যারেট মানে ২১.৬ গ্রাম বা ৩১৯ রতি। তবে প্রাথমিকভাবে ওজন কত ছিল আপনি কল্পনায় করতে পারবেন না। একটা হীরে যার ওজন ছিল ৭৫৬ ক্যারেট। বাকি হিসেব আপনি মনে মনে করে নিন। এবার আসি এই হীরের বিস্তারিত বিবরণ আর ইতিহাস নিয়ে। পুরোটা পড়ে দেখুন জানতে পারবেন অনেক কিছু।
প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বাস ছিল কোহিনূর হীরে (Kohinoor Diamond) যার কাছে থাকবে সে পৃথিবী শাসন করবে। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজদরবারে কোহিনূরের ওজন পরীক্ষা করা হয়। ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী তাভারনিয়ার যাচাই করে দেখেন, হীরের ওজন ২৬৮ ক্যারেটের সামান্য বেশি। ভেনিসের এক ব্যক্তি যিনি হিরে কাটতেন তাকে ডেকে আনেন মুঘল সম্রাট।
কিন্তু হায় রে কপাল! হরটেনসিও জর্জিস নামের সেই ব্যক্তি প্রথম সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেন। অদক্ষ হাতে তিনি হীরে কেটে ফেলেন। ব্যাস আর কোথায় যাবেন ? রেগে যান মুঘল সম্রাট শাহজাহান । কোহিনুর হীরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় এই অতি মূল্যবান হীরেটি হিন্দু, পারসি, মুঘল, তুর্কি, আফগান, শিখ এবং ব্রিটিশ শাসকদের কাছে থেকেছে।
স্যার ওলফের মতে, কোহিনূর মুঘলদের অধিকারে ছিল ২১৩ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিল ৬৬ বছর এবং ২০১১ সাল নাগাদ ব্রিটেনের অধিকারে প্রায় ১২৭ বছর। দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার হিন্দু অধ্যুষিত সন্তোষনগর অঞ্চলে, কল্লর গ্রামের খনি থেকে উত্তোলন করা হয় এই হীরে। তবে কোহিনূর একা নয় একইসঙ্গে এর আরেক দোসর বা বলা যায় যমজ ভাই দরিয়া-ই-নূরও উত্তোলন করা হয়।
এত সুন্দর এই হীরের পরিণতি কী মর্মান্তিক!
কিন্তু কি আশ্চর্য এত সুন্দর এই হীরের পরিণতি কী মর্মান্তিক! (consequences of diamonds are tragic) একেই বোধহয় বলে সুখ সবার কপালে সয়না আর বেশিক্ষণ স্থায়ীও হয় না।এই হীরে সম্পর্কিত এক প্রাচীন পুথি ঘেঁটে জানতে পারা যায় যে, এই হীরে যে ব্যক্তির অধীনে থাকবে, সে পৃথিবী শাসন করবে, এমন এক কথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু সঙ্গী ছিল সাবধানবাণী। পরিণতি হবে মারাত্মক। যাঁর কাছেই এই হীরের অধিকার থাকবে (right of this diamond), তাঁর জীবনে নেমে আসবে চরম দুরবস্থা, দুর্ভাগ্য।
তবে এই বিষয়গুলোর কোনো প্রভাব পড়বে না যদি এই হীরে দেবতার কাছে থাকে বা কোন নারী এর অধিকারিণী হন। তাহলে এই অভিশাপ তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জানা যায়, এই হীরে প্রথম খনি থেকে উত্তোলনের পরই তা মালওয়া রাজবংশের হাতেই তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন তা তারা নিজেদের অধিকারে রাখতে পারেনি। কাকাতিয়া রাজাদের সাথে যুদ্ধে মালওয়া রাজা পরাজিত হন।
এরপর নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। এই দুষ্প্রাপ্য হীরের হাতবদলের সেই শুরু। কোহিনূর চলে যায় কাকাতিয়া রাজার অধীনে। তবে সেখানেও বেশিদিনের স্থায়িত্বকাল ছিল না। রাজধানী বারাঙ্গলের একটি মন্দিরে দেবীর চোখ হিসাবে হীরাটি বসিয়ে কাকাতিয় রাজারা ভেবেছিলেন এই হীরের কেউ সন্ধান পাবে না।কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। তখন দিল্লীর দরবারে তুঘলকি শাসন।
তুঘলক শাহের র এই হীরের বৈচিত্র্যতা জানতে পেরে তা নিজের অধিকার নেয়ার জন্য সচেষ্ট হন। ১৩২৩ সালে তিনি কাকাতিয়া রাজা প্রতাপ রুদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । রাজা প্রতাপ রুদ্র এই অতর্কিত যুদ্ধে প্রাণ হারান। কাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানী বারাঙ্গলে এক মাস পর্যন্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। কত শত হীরা,মাণিক্য, রৌপ্য, গহনা লুন্ঠন করে তা পাঠানো হয় দিল্লীতে যার মধ্যে ছিল সেই অভিশপ্ত হীরাটি (cursed diamond)।
আবার হাত বদল। ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এবার হীরের মালিকানা যায় তুর্কি শাসক ইব্রাহিম লোদির হাতে। সেই সময় আবার মুঘল সম্রাট বাবর ভারত জয়ের লক্ষ্যে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।এটা পঞ্চদশ শতক। গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাদিত্য এ যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির পক্ষ নেন। ইতিহাস দেখে পানিপথের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত হন ।এরপর বাবর পুত্র হুমায়ুন ইব্রাহিম লোদির প্রাসাদে প্রবেশ করেন। প্রাসাদে তখন ইব্রাহিম লোদি ও রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবার।
হুমায়ুন মহিলাদের আশ্বাস দেন যে, প্রাপ্য মর্যাদা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। হুমায়ুনের একথা শুনে ইব্রাহিম লোদির মা একটি বাক্স হুমায়ুনের হাতে তুলে দেন। আর তার মধ্যেই ছিল কোহিনূর। এই সময় থেকেই অভিশপ্ত হীরের নতুন ঠিকানা (address of the cursed diamond) মুঘল সাম্রাজ্য। কিন্তু ঐযে অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস! দিল্লির সিংহাসনে সুলতানি অধিকার কায়েম থাকেনি। আর এই ঘটনা বারবার পর্যবেক্ষণ করতে করতেই অচিরেই প্রশ্ন উঠেছে, এত কাণ্ডের পিছনে কি অভিশপ্ত কোহিনূর?
আরো পড়ুন- শুধু জল খাওয়ার জন্যই কি পুকুর খনন? তাও আবার খাস কলকাতার বুকে?
মুঘলদের সময়েও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই হীরে যখন বাবরের কাছে আসে, বাবর তখন দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তা খুব বেশীদিনের জন্য নয়। রোগে ভোগে মৃত্যু হয়েছিল বাবরের। এরপর বংশ পরম্পরায় হীরের অধিকার পান হুমায়ুন। কিন্তু তার পর দিল্লীর রাজত্ব খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেন নি তিনি। পরবর্তীতে পারস্যের সম্রাট শাহ তামাস্পের সহযোগিতায় দিল্লীর মনসদ ফিরে পান হুমায়ুন।
আরো পড়ুন- একা একলা জীবন কাটানোর কী কী সুবিধা ও অসুবিধা আছে ? Breaking Bharat
কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্রাট হুমায়ুন হীরেটি উপহার দেন শাহকে। ব্যস হাতছাড়া কোহিনূর! কিন্তু কি আশ্চর্য ,এরপর থেকে মুঘলদের রাজত্বকাল মসৃণ ছিল দেশের বুকে। পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ সম্রাট আকবর এবং জাহাঙ্গীরের কাছে এই হিরে ছিল না। ১৬৫৬ সালে জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহান হীরা ব্যবসায়ী মীর জুমলার কাছ থেকে কোহিনূর উপহার হিসেবে পান। আবার অভিশপ্ত হীরের প্রবেশ মুঘল জীবনে। শাহজাহান কোহিনূর হীরাটি তার ময়ুর সিংহাসনে ব্যবহার করেন। একশ বছর পর আবার ফিরে আসে হীরের অভিশাপ।
আরো পড়ুন- আপনি কি বশ হয়ে যাচ্ছেন? আপনাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে? হিপনোটিজম সম্পর্কে জানেন?
মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের ইতিবৃত্ত শুরু হয় সেই থেকেই। শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে উত্তরাধিকার প্রশ্নে তাঁর চার পুত্র এক গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরে ঔরঙ্গজেবের সময়ে মুঘলরাজ ধ্বংস হতে থাকে। এরপর পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমন করে লুঠ করে নেন ময়ূর সিংহাসন সহ এই কোহিনূর হীরা। কিন্তু বেশিদিন হীরে ভাগ্যে রইল না। ১৭৪৭ সাল নাগাদ পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ঘুমন্ত অবস্থায় গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ হারান। কী ব্যাপার ? হাফিয়ে উঠলেন নাকি ? তাহলে ভাবুন কোহিনূরকে কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে এখানেই শেষ নয় আরও খানিক বাকি আছে।
আরো পড়ুন- যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ? মুঠো মুঠো পেইনকিলার খেয়ে নিচ্ছেন না তো? জানেন পেইনকিলার আসলে কি?
পরবর্তীতে আফগানিস্তানের শাসক সুজা শাহ দুররানির কাছে এই কোহিনূর আসে। অষ্টাদশ শতকে শাহ সুজা কোহিনূর নিয়ে লাহরে পালিয়ে আসেন। তবে হীরের অভিশাপ হতে দুররানির পরিবারও রক্ষা পায়নি। শাহ সুজা হীরাটি পাঞ্জাবের শিখ মহারাজা রনজিৎ সিংকে দিয়ে দেন। বিনিময়ে ফিরে পান আফগানিস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে দেন। রনজিৎ সিং জানতেন এই হিরের অভিশাপের কথা।
আরো পড়ুন- নিজের সন্তানকে অভাবের যন্ত্রণাটা বুঝতে দিন? এটাও দরকারি! Breaking Bharat
তাই তিনি এই হীরে উৎসর্গ করেন জগন্নাথ মন্দিরকে। কিন্তু রনজিৎ সিং এর মৃত্যুর পর তার রাজ্যের সুযোগ সন্ধানী ইংরেজরা রাজ্যের বিশৃঙ্খলতার সুযোগ নিতে চেয়েছিল। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ব্রিটিশদের হাতে যায় কোহিনূর হীরে।
আরো পড়ুন- জোয়ার ভাটা কি ভাবে সৃষ্টি হয়? জীবনের উত্থান পতনের সাথে এর কি কোন সম্পর্ক আছে?
লর্ড ডালহৌসি ১৮৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেন হীরাটি। ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোনো সদস্যই এই হীরাটি তাদের কাছে রাখেননি। বরাবরই এটি রানীদের দখলে ছিল। তাহলে ভাবুন, এই হীরে নিয়ে নানা কাহিনী আর নানা ঘটনা, বিতর্ক, প্রশ্ন আর কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে তবে অভিশাপ নিয়ে কেউ দ্বিমত করেননি । তাহলে কোহিনূর কি সত্যিই অভিশপ্ত? কী বলছেন আপনি?