গ্রন্থলোচনা :~
বৃষ্টি পতনের গান কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক (Bidyut Bhowmick) এর কবিতাগ্রন্থ কথা না রাখার কথা”- য় অপূর্ব ছন্দিত ডঃ আদিত্য বসু ( বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবংআলোচক আমেরিকা)
বোস্টন )
Breaking Bharat : কবিতাচর্চায় মনস্কতার একটি বিশেষ অবস্থান সব সময়ই আছে ৷ এখন এই অনুশীলনে ছায়ার সঙ্গে লড়াই অপেক্ষা নিজের ভাবনার সাথে প্রতি মুহূর্তের বিশ্লেষণ বিশেষ জরুরী ৷ একটি লাইন ব্যবহারের আগে তার নিহিত সত্যাসত্য নিয়ে যাচাই করে নিতেই হয় ৷ নইলে এই অন্তরঙ্গতা মাটি পায় না ! হাজার লাইন কবিতা লেখাপেক্ষা মাটির কাছে , মানুষের কাছে যাবার ঐতিহাসিক অনিবার্যতা তাই বোধহয় সচেতন কবিতায় উঠে আসে ৷
এটা একটা পক্ষ ৷ অপর পক্ষে কৈবল্যবাদীদের জ্বালায় এই মানবন্ধন সব সময় যে যথার্থ অঙ্গীকারের আকাশ ছুঁয়ে যায় তা নয় ৷ আর সেই বিপদমান দুই সত্তার লড়াই যেন স্থানু না হয়ে চলতেই থাকে জীবনভোর ; তেমনই পাঠক উদ্ধার করে নেন সেই ছ্যাতা পড়া সত্যকেই ৷ যা দিয়ে আগামীর লেখার পাতা সজীব হয় ৷
এবার চৈত্রের গন্ধে পতঙ্গরা
শরীর নগ্ন
করতে চায় ,
যদিও ছায়াচ্ছন্ন হয় অদূরের
ব্যর্থ আকাশ , সেখানে সৃজন
শৈলীতে আঁকা হবে শহরের
বেশ্যাদের মুখ , ….
অহর্নিশ পারিপার্শ্বিক নত
দুঃখগুলো পরিজন না পেয়ে
বৈরাগ্য নিয়েছে !
তাই শুনে মৃত্যু শুয়েছে
স্পর্শহীন শ্মশান চত্বরে ৷
শেষবার প্রজন্তে অবিশ্রামে
জীবাশ্মের স্পন্দন শুনে
অচম্কা নারী মাতৃলজ্জায়
চোখ বোজে মনের অতলে !
ওই শিরীষের পাতা হাসে , রৌদ্রে যেন চেয়ে আছে স্বপ্নময় চোরাস্রোতে ,
অথচ নবনীতা আরক্তহীন রাতের লাশকাটা ঘরে
মৃত এক নগ্ন পুরুষের পাশে রাত্রি যাপনে !!
[ কবিতা চোরাস্রোত /বিদ্যুৎ ভৌমিক / কাব্যগ্রন্থ -কথা না রাখার কথা ]
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর ৪ ফর্মার মলাটে একটি বর্ণিত আত্মকথন -“কথা না রাখার কথা ৷ যদি উচ্চারণ করি , “কেউ কথা রাখেনি” ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ) তাহলে যেন বিসর্গ চিন্তনের দুঃখানুভব কবিকে তাঁর অষ্টপ্রহর ইষ্টনামের মনো একটি কঠিন সিদ্ধান্তকে অন্তরে স্থাপিত করে ৷ এবং এরমধ্যে একপ্রকার নঙর্থক অভিজ্ঞতা কবিকে আগামীতে কিছু বলার শক্তি জোগায় ৷
তেমনই কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক – এর ” কথা না রাখার কথা” – য় এক প্রকার প্রশয় থাকে ৷ যেখানে তিনি সিদ্ধান্তে না গিয়ে অপরূপ অভিজ্ঞতাকে নিজের মধ্যেই ধরে রাখেন এবং অনুপুঙ্খ অন্ময়তায় উচ্চারণ করেন একটি “ধ্রুপদী হদয়তান্ত্রিক উচ্চারণ” সব শব্দ ঘুমিয়ে পড়ার পর ; নিঃশব্দরা চুপিচুপি জেগে ওঠে” – I আর সেই নিভৃত অন্তরালে কবি রচনা করেন তাঁর অবসরের কবিতা প্রহর ৷
আরো পড়ুন- Poet Bidyut Bhowmick : বিশিষ্ট কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কলমে একটি সহজ সত্য কাব্যিক উচ্চারণ
কবির নাম কবিতায় একটি আদ্যন্ত স্পষ্ট অনুভূতি বারবার আমাদের ফিরে পড়ায় ৷ এখানে একটি শপ্ শপে ভিজে জলবায়ুর বৃষ্টিছাড়া মেঘ যেমন আছে তেমনই আছে তাকে অতিক্রম করে বৃষ্টি পতনের গান ৷ তাই তাঁর স্পষ্ট এবং ব্যতিক্রমী লাইন “যে পৃথিবী ভেজার কথা সে পৃথিবী ভেজেনি” ৷ আর তাই “যে কবিতা লেখার কথা সে কবিতা আসেনি” ৷ এই ছটফটানি কিম্বা আত্মখেদ দিয়েই কবি বেঁচে থাকেন ৷
বেঁচে থাকে কবিতা | রিলকে তাই তাঁর নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতাটির জায়গায় একটি করে টাটকা গোলাপ দিয়ে রাখতেন ৷ আবার নিজেকে চিনতে চিনতে নিজের লেখা পড়তে পড়তে তিনি যখন লেখেন ,”আমি যেন ভাঙছি নিজেকে , আমার প্রত্যন্ত গভীরের সেল্ গুলো অকপটে একই সঙ্গে ভাঙছে”( বৃষ্টি শেষে আবার বৃষ্টি ) তখন এক উত্তরণ তাঁকে চিনে নিতে শেখায় ৷
আরো পড়ুন- Bidyut Bhowmick : কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর নষ্ট প্রেমের কবিতা
এখানে সত্য যাকে একটি নিপাট বুননের অভীক্ষায় ৷ আর সেই উত্তরণ সত্য হয় আরও স্পষ্ট হয় তাঁর লেখায় ” আড়ালে অচ্ছুৎ জ্যোৎস্না , প্রচ্ছন্ন সতরঞ্জ জুড়ে / কী ভীষণ উষ্ণ গন্ধে প্রাণ নড়ে জ্বলন্ত বৈধব্যে” ৷ কথা উঠতে পারে কি সেই জ্বলন্ত বৈধব্য ! তা কি “ধ্রুপদী কথোপকখন ঘর থেকে রাস্তায়” এসে মেলে ধরে “অসমাপ্ত ডায়েরি”- র পাতা | যেখানে রবীন্দ্রগানের পরামর্শ কবি বিদ্যুৎ কে ক্লান্ত করে ৷
পরিশ্রান্ত হদয়ের উৎসে দিয়ে যায় নিবিড় ঐক্যের গান “সে চলে গেল বলে গেল না , সে কোথায় গেল ফিরে এল না” ৷ কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর “ছায়াপদ্য” এই ধরনের একটি মথিত অবগাহন হলেও “মহল্লার অন্ধকার নিয়ে শিরীষ গাছ” হয়ে বেঁচে থাকে ৷
আরো পড়ুন- Bidyut Bhowmick : কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর অপ্রকাশিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী কবিতা
অথচ আমরা ভুলে যাই “বৃষ্টি কী অতীব জরুরী” ( মৃত্যু তাঁকে ধাওয়া করেছে ) | বেশকিছু কবিতার শব্দচয়ন , বাক্ মহিমা সর্বোপরি ছবিতার চিত্রধ্বনি খুব ক্লোজআপে কবিকে চিনতে সাহায্য করে তুল্যমানতার বিচারে কয়েকটি পারস্পরিক শব্দ সহযোদ্ধা অনেক সময়ই তাঁকে শব্দের কঙ্কাল উপহার দিয়েছে ৷ শব্দ চয়ন এসেছে যত সহজে ভাবনায় অনেক কম ভারি তারা ৷
আরো পড়ুন- Poet Bidyut Bhowmick : কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কলমে দুটি আন্তর্জাতিক মানের কবিতা
এ প্রসঙ্গে “অস্তিত্বের কদম ফোটাই গন্ধর্ব বিধিতে” কিম্বা “চৈতন্যে ফিরেছে প্রেমের সর্বনাশ”- এর মতো কবিতাগুলি মনে করাই ৷ শব্দ চয়নের অভিজাত্য অনেক সময়েই দুর্বল করে দেয় সামগ্রিক ভাবনাকে ! তবুও কবি সতর্ক তাঁর কাব্যে ৷ কারণ “এখানে .স্বপ্ন প্রবাহমান ” ৷ সবদিক দিয়ে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কাব্যগ্রন্থ ” কথা না রাখার কথা” পেছন মলাটের আত্মস্তুতি বাদ দিয়ে ভালো লাগার ৷ তাঁর কবিতা লেখার .হাত আরও মজবুত হোক. | আমরা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম ৷ বইয়ের প্রচ্ছদ মনে ধরেনি ৷
কথা না রাখার কথা – বিদ্যুৎ ভৌমিক (আনন্দময়ী প্রকাশনী কলকাতা ৭০ / মূল্য ৬০ টাকা)